যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার প্রলোভনে নারীদের সঙ্গে ‘রোমান্স স্ক্যাম’, কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৩, ০৯:১৫ রাত
ছবি সংগৃহীত
সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় অর্ধশত নারীর সঙ্গে ‘রোমান্স স্ক্যাম’ ও প্রতারণার অভিযোগে মো. বেনজির হোসেন (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।
সিটিটিসি বলছে, বেনজির ফেসবুকে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করতেন। পরে বিয়ে ও সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন তিনি। প্রথমে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে এর সুযোগ নিয়ে লাখ লাখ টাকা এমনকি কোটি টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন বেনজির।
সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, বেনজির এক বিমান চালক আমেরিকা প্রবাসীর প্রোফাইল হুবহু কপি করে নিজের একটি ফেক ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করে। প্রোফাইলটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তিনি নিয়মিত বিমান চালানোর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন। তিনি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদ ফেলত। পরে বিয়ে ও সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন।
ভিকটিমদের সঙ্গে তিনি অডিও কলে কথা বললেও কখনোই ভিডিও কলে কথা বলতেন না। অনলাইন প্রণয়ের একপর্যায়ে তিনি বিভিন্ন সময় বিপদে পড়ার কথা বলে বিভিন্ন নগদ অ্যাকাউন্টে (প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা ১৯টি নগদ অ্যাকাউন্টের বিষয়ে জানা গেছে) ধাপে ধাপে লাখ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। প্রতারক বেনজিরের প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১৩টি নগদ অ্যাকাউন্টে গত ৪ মাসে ১ কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
প্রতারক বেনজিরের বাড়ি নড়াইল হলেও টাকাগুলো ক্যাশ আউট করতেন তার বাড়ি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে যশোর ও খুলনা জেলার বিভিন্ন নগদ ক্যাশ আউট পয়েন্টে। তার প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিম এবং নগদ অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করা অন্য ব্যক্তির নামে। ক্যাশ আউট করার সময় প্রতারক বেনজির পরিচয় ও চেহারা গোপন করার জন্য ক্যাপ, সানগ্লাস ও মুখে মাস্ক পরে থাকতেন।
তিনি আরও জানান, প্রতারক বেনজিরের প্রতারণার স্বীকার হয়ে গত সাত মাসে বিভিন্ন নগদ নম্বরে প্রতি মাসে ১৪-১৫ লাখ করে টাকা দিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা খুইয়েছেন স্বপ্না (ছদ্মনাম) নামের এক সিঙ্গেল মাদার। একই সময়ে জান্নাত (ছদ্মনাম) প্রতারক বেনজিরের কাছে খুইয়েছেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। প্রতারক বেনজির হোসেনের স্মার্ট ফোনে ৫০টিরও বেশি এ ধরনের নারীর সন্ধান পাওয়া যায়।
স্বপ্না ও জান্নাত গত এক সপ্তাহের মধ্যে ভিন্ন সময়ে অভিযোগ নিয়ে সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে প্রতিকারের জন্য আসেন। স্বপ্না রাজধানীর ওয়ারী থানায় প্রতারণার বিষয়ে গত ২১ নভেম্বর মামলা দায়ের করেন। পরে ২২ নভেম্বর ছায়া তদন্তে নেমে বিশদ প্রযুক্তিগত অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে অভিযুক্তকে বেনজিরকে শনাক্ত করা হয়। এরপর খুলনার ফুলতলায় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নগদ নম্বর থেকে ক্যাশ আউট করার সময় তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও গত কয়েক বছরে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন বেনজির। তিনি গত কয়েক বছরে প্রতারণার অর্থে ৫ বিঘা জমির ওপর বাগান বাড়ি (২ তলা ডুপ্লেক্স ভবন) বানিয়েছেন। এছাড়া, আনুমানিক ৩ বিঘা জমির ওপর বিলাসবহুল ভবন কিনেছেন। নড়াইলে বিভিন্ন জায়গায় আনুমানিক ২০ বিঘা মাছের খামার, নড়াইলে বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ভবন, যশোর ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবনসহ বিপুল ব্যাংক-ব্যালেন্সও রয়েছে তারা।
এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বেনজির এইচএসসি পাস করে একটা চাকরিতে যোগ দেন। পরে চুরির দায়ে সেই চাকরি চলে যায়। তিনি খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা বিভিন্ন হাট-বাজারে তালের শাঁস বিক্রি করতেন। তবে বেনজির খুব মেধাবী ছিলেন। তার বৈধ কোনো পেশা নাই। তার মূল পেশাই প্রতারণা করা। এলাকার মানুষ তাকে সন্দেহ করত। কিন্তু নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় তাকে কিছুই বলত না।
তিনি বলেন, একজনের অভিযোগের ফলে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। তার প্রতারণার শিকার অসংখ্য নারী। আমরা ইতোমধ্যে ৫০ জনকে পেয়েছি যারা বেনজিরের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তার প্রতারণার শিকার হয়ে এক নারী আত্মহত্যাও করেছেন। নারীদের কাছ থেকে আপত্তিকর ছবিও সংগ্রহ করতেন। অনেক ভুক্তভোগী সম্মান হারানোর ভয়ে এসব প্রকাশ করতে চান না।
ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কী বলে টাকা নিতে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেনজির বলতেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে তার ক্রেডিট কার্ড বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি বানিয়ে গল্প বলতেন এবং এর মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলতেন। এরপর আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভুয়া প্রমাণ দেখাতেন। যে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, বেনজির তাকে একটি ভিসার কপিও পাঠিয়েছে। এসব বিশ্বাস করানোর জন্য বেনজির নানা গল্প সাজাতেন। বেনজির ওই নারীর কাছ থেকে ছয় মাসে এক কোটি টাকারও বেশি টাকা নিয়েছেন।