ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খতনায় আয়ানকে যে পরিমাণ ওষুধ দিয়েছে, বাইপাসেও এত দেয় না

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: জানুয়ারী ২৯, ২০২৪, ০৯:১০ রাত  

ছবি সংগৃহীত

শিশু আয়ানের খতনায় যে পরিমাণ ওষুধ ব্যবহার হয়েছে, হার্টের বাইপাস সার্জারিতেও এত ওষুধ দেওয়া হয় না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আয়ানের মৃত্যু নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ করেছে তাকে ‘লোক দেখানো’ এবং ‘হাস্যকর’ বলেছেন। এছাড়া আয়ানের বিষয়ে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবহেলা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

সোমবার (২৯ জানুয়ারি) এ বিষয়ে শুনানি শেষে পুনরায় তদন্তের আবেদন পর্যালোচনা করে তা এফিডেভিট আকারে হাইকোর্টে জমা দিতে আদেশ দেওয়া হয়। এরপর এ বিষয়ে আরও শুনানি ও আদেশের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করেন আদালত।

এসময় তদন্ত প্রতিবেদনে সুরতহাল রিপোর্ট নেই কেন বলেও প্রশ্ন তোলেন আদালত? একই সঙ্গে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে কি না- তাও জানতে চান।

হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন এবিএম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সেলিম আযাদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনিচ উল মাওয়া (আরজু)।

এসময় শিশুর বাবা শামীম আহমেদ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কুমার দেবুল দে। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট এসকে ওমার শরীফ।

শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন এফিডেভিট আকারে জমা না দেওয়ায় দুপুরে শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন আদালত। এরপর দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে শুনানি হয়।

শুনানিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন পড়েন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। শুনানির সময় আদালত আয়ানের সুরতহাল করা হয়েছিল কি না প্রশ্ন তোলেন। তখন আইনজীবীরা বলেন সুরতহাল হয়নি।

পরে আদালত জানতে চান পোস্টমর্টেম করা হয়েছে কি না। জবাবে আইনজীবীরা বলেন, হয়েছিল।

এসময় হাসপাতালে শিশু আয়ানের চিকিৎসায় কোন ডাক্তার ছিলেন জানতে চাইলে আদালতকে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের নাম জানায়।

এ পর্যায়ে ডাক্তারদের (চিকিৎসায়) ব্যবহৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার টার্ম (মেডিকেল রিলেটেড সর্ট ট্রাম) বিষয়ে অবহিত হতে উপস্থিত এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ডায়াসে ডাকা হয়। তিনি আসার পর প্রতিবেদনের বাকি অংশ পড়া হয়।

এসময় ওই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওষুধ ও ইনজেকশনের বিষয়ে বুঝিয়ে দেন। আন্তর্জাতিক মেডিকেল রিলেটেড সর্ট ট্রামেও এসব ব্যবহার হয় বলে জানান ডাক্তার। এরপর রিটকারী আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ মাসুম শুনানি করেন।

তখন আদালত বলেন, গ্রামে ম্যানুয়ালি খতনা করা হয়, কিন্তু কিছুই হয় না। অথচ এত কিছু চেক করার পরও বুঝতে পারলেন না ছেলেটা অসুস্থ। যদিও আমরা জানি কোনো ডাক্তারই চান না যে রোগী মারা যাক।

এসময় শিশু আয়ানকে ইনজেকশন দেওয়ার সময় চিকিৎসকের অবহেলার কথা তুলে ধরা হয়। তখন আদালত বলেন, ওপেন হার্ট সার্জারি করলেও এত ওষুধের প্রয়োজন হয় না, যে ওষুধ দিয়েছেন আয়ানের খতনার জন্য।

হাইকোর্ট আরও বলেন, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা আছে জানার পরও যদি এনেসথেসিয়া দেওয়া হয়, মাথায় রক্ত জমা হয়ে যেতে পারে। কোনো চিকিৎসকই রোগীর মৃত্যু চান না, তবে এখানে আয়ানের ক্ষেত্রে অবহেলা দেখা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী মাসুম সাংবাদিকদের জানান, আদালত বলেন, এখানে আয়ানের ক্ষেত্রে নেগলিজেন্স (অবহেলা) দেখা যাচ্ছে। ছেলেটির অ্যাজমা জেনেও অপারেশনের সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো?’

অন্যদিকে, আয়ানের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধের তথ্য দেখে হাইকোর্ট বলেন, বাইপাস সার্জারিতেও এত ওষুধ লাগে না। এখানে শিশুটিকে যত ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

রিটকারী আইনজীবী জানান, শুনানির একপর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির দেওয়া রিপোর্টকে ‘লোক দেখানো’ ও ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। সেই সেঙ্গে চিকিৎসকদের একটা ডিসিপ্লিনে চলা উচিত বলে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।

এসময় ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স’ বিষয়ে একটি টিম বা বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

শিশু আয়ানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন ‘মেনুপুলেটে’ বা ‘কারসাজি’ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে এ ঘটনায় পুনরায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চান রিট পক্ষের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। এরপর আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন।

এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাড্ডার সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করানোর জন্য আনা হয় আয়ানকে। সেদিন সকাল ৯টায় তাকে অজ্ঞান করা হয়। এরপর বেলা ১১টায়ও তার জ্ঞান না ফিরলে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এনে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ৭ জানুয়ারি রাতে লাইফ সাপোর্ট খুলে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

আয়ানের পরিবারের অভিযোগ, আংশিক অচেতন করে খতনা করানোর কথা থাকলেও চিকিৎসকরা আয়ানকে পুরোপুরি অজ্ঞান করেন। অন্যদিকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আয়ানের যে মৃত্যুসনদ দেয় তাতে বলা হয়, আয়ানের মৃত্যুর কারণ কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেইলিওর, মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।

আয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম জনস্বার্থে রিট করেন। সেই রিটে আয়ানের বাবাও পক্ষভুক্ত হন। এতে শিশু আয়ানের চিকিৎসায় যুক্ত থাকা চিকিৎসকদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তাদের ডাক্তারি সনদ বাতিল ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়।

পরবর্তীতে শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

সে অনুযায়ী ১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করে অধিদপ্তর। যেখানে বলা হয়, আয়ানের ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা (হাঁপানি) ছিল। খতনার অপারেশনের আগে ওয়েটিং রুমে তাকে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া হয়। অথচ এ বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়নি।

তবে আইনজীবী হাইকোর্টকে বলেন, আয়ানের অ্যাজমার বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়েছিল।

অন্যদিকে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অস্ত্রোপচারের আগে আয়ানকে অ্যানেস্থেসিয়ার জন্য প্রয়োগ করা ইনজেকশন মারাত্মক অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফিল্যাকটয়েড রিয়্যাকশন) সৃষ্টি করতে পারে। ফলে শ্বাসতন্ত্র সংকুচিত হয়ে (ল্যারিঙ্গো স্পাজম) বা (ব্রঙ্কোস্পাজম) শ্বাসনালীর আশপাশের পেশিশক্ত হয়ে খিঁচুনি হয়ে থাকতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এছাড়া সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) ও ওষুধ (মেডিকেশন) দিয়ে আয়ানের হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনতে ১০ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। ফলে হাইপক্সিক ব্রেন ইনজুরি (মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে মৃত্যু) হয়ে আয়ানের মৃত্যু হতে পারে।

তবে রিট পক্ষের আইনজীবী শিশু আয়ানের পাজড়ের হাড় ভেঙে ফেলার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন।