বাংলাদেশে বৃহত্তর বিদেশি বিনিয়োগ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৩, ০৬:৪১ বিকাল
ছবি সংগৃহিত
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আরো বিদেশি বিনিয়োগ চেয়ে বলেছেন, তাঁর সরকার বৃহত্তর বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আরো বেশি পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ যাতে বাংলাদেশে আসতে পারে সেজন্য আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে ‘হোটেল রেডিসন ব্লু’তে ফরেন ইনভেস্টরস্ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই-ফিকি) -এর ৬০ বছর পূতি উদযাপন এবং দু’দিন ব্যাপী ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০২৩ এর উদ্বোধনকালে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
‘আমরা সারাদেশে ১শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ৩৯টি হাই-টেক পার্ক প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করেছি। এগুলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এককভাবে কোন দেশ যদি এক খন্ড জমি চায় আমরা তাও দেব আবার যদি কেউ যৌথ উদ্যোগে করতে চান সেটাও করা হবে অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে করতে চাইলে সেটাও করা হবে।’
তিনি বলেন, তাঁর সরকার অনেকগুলো সংস্থা তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), বাংলাদেশ ইকোনমিক প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি (এইচটিপিএ) এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপিএ)। বিনিয়োগের সুবিধার্থে বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে ওয়ান স্টপ পরিষেবা চালু করা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, বিনিয়োগ পরিষেবা প্রদানকারী সমস্ত অফিস সম্পূর্ণ অনলাইন এবং ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। একইসাথে কর মওকুফ, রেমিটেন্স রয়্যালটি, প্রস্থান নীতি, লভ্যাংশ এবং মূলধন সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন, আইন দ্বারা বিদেশী বিনিয়োগ সুরক্ষাসহ বিনিয়োগ নীতিকে আরও সহজ করার জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এ সরবরাহ খাত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংশ্লিষ্ট খাত এবং পর্যটন খাতকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
‘ব্লু-ইকোনমি’র প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ব্লু-ইকোনমি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমরা নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। লজিস্টিক শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে অন্যান্য শিল্প খাতের উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষে জাতীয় লজিস্টিকস ডেভেলপমেন্ট পলিসি প্রণয়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশে এখন জ্বালানি, পানি, লজিস্টিকস এবং পরিবহন খাতে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো গড়ার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে শুধু লজিস্টিকস খাতই ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হবে শেখ হাসিনা বলেন, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ও শক্তিশালী রপ্তানি কৌশল এবং শিল্পনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে জিডিপি-তে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত করতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এখন প্রায় সতের কোটি মানুষের একটি বড় অভ্যন্তরীণ বাজার। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির মতো প্রতিষ্ঠিত বাজারগুলোকে এবং বর্তমান উচ্চ-প্রবৃদ্ধির ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডকে আমাদের দেশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত ও ধনীক শ্রেণির সংখা হবে ৩ কোটি ৪০ লাখ। ২০৪০ সালের মধ্যে আনুমানিক মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ৫ হাজার ৮৮০ মার্কিন ডলার। কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ৩শ’ কোটি মানুষের আঞ্চলিক বাজারের কেন্দ্রস্থল হতে পারে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, ফিকি’র সভাপতি নাসের ইজাজ বিজয় ও সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি দীপল আবেবিক্রমা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী কয়েকজন আন্তর্জাতিক সফল বিনিয়োগকারীও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।‘ফর এভার ফিউচার ফরওয়ার্ড’ শিরোনামের একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী ফিকির গবেষণা প্রতিবেদন ‘ক্যাটালাইজিং গ্রেটার এফডিআই ফর ভিশন-২০৪১: প্রাইওরিটিজ ফর বিল্ডিং এ কনডাক্টিভ ট্যাক্স সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’ এবং ইএসজি কমিটি প্রণোদিত ‘ইএসজি স্ট্রাটেজিস এন্ড ইমপাক্টস ফ্রম দি মেম্বারস অব এফআইসিসিসিআই’ শীর্ষক দু’টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচান করেন।
প্রধানমন্ত্রীকে প্রখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের তৈরি একটি স্মারক উপহার দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রতীক।বিডা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হল এফআইসিসিআই’র ৬০ বছর উদযাপন এবং বিনিয়োগ এক্সপো-২০২৩-এর কৌশলগত অংশীদার।
ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো -২০২৩ এফআইসিসিআই সদস্য এবং সরকারি স্টেকহোল্ডারদের প্রদর্শকদের সাথে স্থানীয় এবং বিদেশী উভয় বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করে ৪০টি স্টল প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করেছে।
‘রেডিসন ব্লু’ এর ওয়াটার গার্ডেনে ‘ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০২৩’ আজ এবং আগামীকাল চলবে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
আরও পড়ুনঃ ওরা স্যাংশনের দেশ, দিতে পারে: যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচি, বিনিয়োগবান্ধব নীতি, বৃহৎ অভ্যন্তরীণ বাজার, কৌশলগত অবস্থান, উচ্চ মুনাফা, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সুবিধার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং রপ্তানির জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, এসকল সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ এখন ২০৩১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মোট জনগোষ্ঠীর ৭৮.৫৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ফ্রিল্যান্সার রয়েছে যা বিশ্বব্যাপী অনলাইন শ্রমের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী। আইসিটি রপ্তানি খাতে ২০২৩ সালে আমরা অর্জন করেছি ১.৯ বিলিয়ন ডলার। আশা করা হচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ এই খাতে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে।
‘শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়সমূহ ও বাণিজ্য সংহতকরণের ফলে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২,৭৯৩ মার্কিন ডলারে।
জিডিপির আকার ২০০৬ সালের ৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫০.৩১ লক্ষ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দারিদ্রের হার প্রায় ৩ গুণ কমে ১৮.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উৎপাদন খাত ছাড়াও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে ব্যক্তিখাতে ভোগ বৃদ্ধি, যাকে প্রাথমিকভাবে সহায়তা করছে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ, শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতি, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ ও জ্বালানি খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের বিগত প্রায় ১৫ বছরের উন্নয়নের কৃতিত্ব দেশের বেসরকারি খাতের। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেই। গত ১৫ বছরে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের উন্নয়নে নানা মূখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছি। এর ফলে বেসরকারি খাত আরও শক্তিশালী ও বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
সরকার প্রধান বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা মাত্র ৩ বছর ৭ মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। যেটা ’৭৫ সালে আমরা স্বীকৃতি পাই কিন্তু এরপর আর বেশিদূর এগুতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং বাণিজ্য সংহতকরণের ওপর ভিত্তি করে আজকের এই টেকসই অর্থনীতি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে এবং
২০২৬ সাল থেকে এই উন্নয়নশীল দেশের অগ্রযাত্রা শুরু হবে। তার প্রস্তুতিও আমরা এখন থেকে নিচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আশা করা হচ্ছে ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। কারণ, জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজিও তাঁর সরকার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে এবং এতে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক সমস্যার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। তবুও এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
তিনি ফিকি’র সকল সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তারা আমাদের লক্ষ্যের সাথে একাত্ত্বতা প্রকাশ করে টেকসই ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসার বিকাশ ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখছে। আমাদের দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে ফিকি’র প্রকাশনা দু’টি এবং ‘ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০২৩’ সহযোগিতা করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
২৪ ঘন্টা আপডেট নিউজ পেতে bdtribune24/বিডিট্রিবিউন২৪ এর ফেসবুক পেজ ফলো করুন