দশমিনায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৩, ০৯:৫০ রাত
ছবি সংগৃহীত
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার আরজবেগী এস এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র তন্ময় চক্রবর্তী নির্বাচনী পরীক্ষার ফি না দিতে পারায় প্রধান শিক্ষকের অপমান ও মারধরে অভিমানে গ্যাস ট্যাবলেট (কীটনাশক) খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভ বিরাজ করেছে। তবে এ দায় নিতে নারাজ প্রধান শিক্ষক। অন্যদিকে, তন্ময়ের এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৯ অক্টোবর (সোমবার) দুপুরে। এদিন ১০ম শ্রেণির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ে পরীক্ষা ছিল। অন্য সবার মতো তন্ময়ও সঠিক সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে হাজির হয়। এমন সময় পরীক্ষার হলের কক্ষ পরিদর্শক মরিয়ম বেগম তন্ময়কে ডেকে বলেন, তোমার টাকা বকেয়া আছে। তুমি পরীক্ষা দিতে পারবে না। প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে অনুমতি নিয়ে আসো।
কক্ষ পরিদর্শকের কথামতো তন্ময় প্রধান শিক্ষক কাওসার হোসেনের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, টাকা ছাড়া তোমার পরীক্ষা দেওয়া হবে না। এরপর তন্ময় বাইরে যায় এবং কিছক্ষণ পর ফিরে এসে পরীক্ষায় বসার অনুমতি চাইলে প্রধান শিক্ষক সহপাঠীদের সামনে তন্ময়কে নেশাখোর বলে চড়-থাপ্পড় দেন। এই অভিমানের তন্ময় বিদ্যালয় ভবনে বসেই গ্যাস ট্যাবলেট (কীটনাশক) পান করে। কিছুক্ষ পর ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হলে সে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে যায় এবং সেখানে গিয়ে বমি করে পড়ে যায়। তখন তন্ময়কে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা মিলে দশমিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মিঠুন চন্দ্র হাওলাদার তন্ময়কে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় বিকেল ৫টায় তন্ময়ের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুনঃ র্যাবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ
এ বিষয়ে তন্ময়ের সহপাঠী রিফাত বলে, তন্ময়, আমি ও আরও কয়েকজনকে মরিয়ম ম্যাডাম প্রধান শিক্ষকের কাছে পাঠান। স্যার তখন তন্ময়ের সঙ্গে অনেক রাগারাগি করেন। আর আমাদের অনুমতি দেওয়ায় আমারা পরীক্ষার হলে চলে যাই। পারে শুনি তন্ময় গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়েছে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
ওই সময় প্রধান শিক্ষক কাওসার আলম বলেছিলেন, কি হয়েছে জানি না। বিদ্যালয়ে আসার পর তন্ময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমরা জানার সঙ্গে সঙ্গে দশমিনা হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। সেখানেও নিয়ে যাওয়া হয়। পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে টাকা বকেয়া থাকায় পরীক্ষা দিতে অনুমতি না দেওয়া এবং চড়-থাপ্পড় দেওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করেন।
তন্ময়ের মা জয়ন্তী রানী চক্রবর্তী বলেন, প্রধান শিক্ষক টাকা না দিলে পরীক্ষা দিতে দেবে না বলে আমার ছেলেকে স্কুল থেকে চলে যেতে বলে। আমি সন্ধ্যা ৬টায় শুনি তন্ময় গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে পটুয়াখালী হাসপাতালে মারা গেছে।
তন্ময় দশমিনা সদর ইউনিয়নের আরজবেগী গ্রামের মৃত গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তী ছেলে। দুই ভাই বোনের মধ্যে সে ছিল ছোট। তার বড় বোন তন্নি চক্রবর্তী আরজবেগী এস এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক। তিনি বরিশাল মহিলা কলেজের অনার্স কোর্সে কেমিস্ট্রি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তন্ময়ের বাবা আরজবেগী এস এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
তন্ময়ের বোন তন্নি চক্রবর্তী বলেন, আমার ভাই খুব অভিমানী ছিল। সবার সঙ্গে তেমন কথা বলতো না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ও একটু ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ হয়ে যায়। সেদিন স্কুলে কি ঘটেছিল সেটা আমি দেখিনি। তবে প্রধান শিক্ষক তাকে বেশি শাসন করতে গিয়ে অভিমানে কীটনাশক ওষুধ খেয়েছে। আমি এই স্কুলেরই খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আছি।
এ ঘটনায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবেন কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন আমাদের অভিভাবক নেই। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগে। একটা মাত্র ভাই সেও চলে গেছে। আমি মামলা করলে তো আর আমার ভাই ফিরে আসবে না। মামলা করতে হলে অভিভাবকের দরকার। এই মামলা কে চালাবে। আর মামলার ফলাফল আসলে তো আর আমার ভাই ফিরে আসবে না।
তিনি আরও বলেন, বাবার মৃত্যুর পর তন্ময়ের স্কুলের বেতন সম্পূর্ণ ফ্রি করে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে নির্বাচনী পরীক্ষার ফি সবাইকেই দিতে হয়। তন্ময় যে ফি দেয়নি সেটা জানা ছিল না।
তন্নি বলেন, তন্ময় কিছুদিন হলো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেছিল পড়াশোনা ঠিকমতো করছিল না। এজন্য প্রধান শিক্ষক তাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে শাসন করে। তবে শাসনের পরিমাণটা একটু বেশি হওয়ায় সে অপমান বোধ করে। এজন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় বলে তার বোন জানান।
এ ঘটনায় তন্ময়ের গ্রামের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর গাজী বলেন, তন্ময়ের বাবা গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তী এই স্কুলেরই সাবেক শিক্ষক ছিলেন। তিনি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তন্ময়ও খুব ভালো এবং নম্র,ভদ্র ছেলে ছিল। এই স্কুলের শিক্ষকদের আরও সচেতন হতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী যেন আর অভিমান না করতে পারে।
আরেক প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম বলেন, তন্ময় খুবই হাসি খুশি একটি ছেলে। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না আমরা। তবে আমাদের সন্তানদেরকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। এই স্কুলে যে শিক্ষকরা রয়েছেন তারা অবশ্যই এই ঘটনায় দায়ী। স্কুল চলাকালীন অনেক শিক্ষার্থী বাজারে ঘোরাফেরা করে। অন্যান্য স্কুলের চেয়ে এই স্কুল ফলাফলেও অনেক পিছিয়ে।
আরেক প্রতিবেশী মাহাতাব মুন্সী বলেন, তন্ময়কে আমরা কখনোই খারাপভাবে দেখিনি। তবে স্কুলের শিক্ষকদের কিছুটা অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার পরে আমরা মানববন্ধন ও মিছিল করেছি। তন্ময়ের পরিবার কেন যে মামলা করছে না বিষয়টি আমরা বুঝে উঠতে পারছি না
তন্ময়ের সহপাঠী নাজমুলের বাবা মো. গাজী জাহাঙ্গীর বলেন, তন্ময় আমার ছেলের বন্ধু। তন্ময়ের ঘটনার আগের দিন পর্যন্ত ওরা পাঁচটি পরীক্ষা দিয়েছে। তন্ময়ের বাবা সেও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তন্ময়ের বাবা সে অসহায় শিক্ষার্থীদের খাতা কলম কিনে দিতেন। তার সময়ে কোনো ছেলে মেয়েদের যদি টাকার সমস্যা থাকতো তাদের টাকার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করতেন। তন্ময়ের মতো এ রকম কোনো ছেলে সমাজ থেকে যেন আর ঝরে না যায় আমরা সেটাই চাই।
এ বিষয়ে জানতে আরজবেগী এস এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাওছার বলেন, আপনার এতো প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না। যার সন্তান মারা গেছে সেই বুঝবে তার কি করতে হবে? আমি কাউকে বেতনের জন্য পরীক্ষার হলে যেতে নিষেধ করিনি। তাদের যদি অভিযোগ থাকে তাহলে তারা মামলা করুক।
এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসার মুহা: মুজিবুর রহমান বলেন, তন্ময়ের আত্মহত্যার বিষয়টি আমি শুনেছি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলছি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার জন্য। তবে পরীক্ষার ফি’র জন্য একজন শিক্ষার্থীকে হল রুম থেকে বের করে দেওয়াটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি বিষয়টি সত্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দশমিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাফিসা নাজ নিরা বলেন, আত্মহত্যার ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তবে তন্ময়ের পরিবার যদি মামলা করেন তাহলে তাদের আইনি সহায়তা করা হবে। এখানে যাদের পরিবারের সন্তান তারা যদি এগিয়ে না আসেন তাহলে আপনি আমি কিছুই করতে পারবো না।
এ বিষয়ে জানতে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. নূর কুতুবুল আলম বলেন, আমরা কিন্তু বীরের জাতি। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। এতো ছোট বিষয়ে এতোটা আবেগি হওয়ার কোনো দরকার ছিল না। তার অভিভাবক আছে, আমরা আছি, আমাদের জানালে আমরা সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পারতাম। তার পরিবার যদি মামলা করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তরুণ সমাজ ও যুবসমাজকে আরও শক্ত হতে হবে।