ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বারমাসি চাষযোগ্য পেঁয়াজ আবিষ্কার; দরকার সরকারি উদ্যোগ

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৩, ০৬:০০ বিকাল  

ছবি সংগৃহীত

বর্তমান সারাদেশের বাজারেই যেন পেঁয়াজের একক রাজত্ব বিরাজমান। পেঁয়াজের ঝাঝের সাথে ঝাঝ রয়েছে দামেরও। চলমান বাজারদর অস্থিরতায় সারাদেশে দাম নিয়ে পেঁয়াজ ঘটিয়েছে এক লঙ্কা কান্ড। সরকার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে লাখ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করলেও কিছুতেই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কমছেনা দাম। এখনো খুচরা বিক্রি মূল্যে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১৮০-১৯০ টাকা পর্যন্ত। কোথাও কোথাও ২০০-২২০ টাকা। ঠিক সেই মূহুর্তে এক আশার আলো জাগিয়েছেন গবেষকরা।

গবেষকরা বলছেন নিজ দেশীয় উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই দেশের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব। চাহিদা মিটিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনায় বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে শতকোটি টাকার পেঁয়াজ। আর নিজ দেশে এর দাম হবে প্রতি কেজি মাত্র ৩০-৩৫ টাকা দরে! এতে সরকারেরও বেঁচে যাবে হাজার কোটি টাকা। আশ্চর্যজনক হলেও এমনই এক উচ্চফলনশীল বারি পেঁয়াজ ওফ-৫ নামে অগ্রবর্তী জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষি বিজ্ঞানী ড. মহব্বত উল্লাহ।

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের উদ্যানতত্ত্বের পরিচালক ড. মুন্সি রশিদ আহমদ দায়িত্ব পালনকালে ২০১৯ সালে খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণায় এ পেঁয়াজের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তখন খাগড়াছড়ির সাংসদ ও ট্রাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা-এনডিসি সহ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা সরজমিনে এসব পেঁয়াজের প্লট পরিদর্শন করে সারাদেশে এ পেঁয়াজ চাষের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এরপর ২০২০ সালে মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে এ প্রচেষ্টা। তবে বর্তমানে খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগিতায় এ পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের উদ্দুদ্ধ করা হচ্ছে। এখন শুধু দরকার সরকারি উদ্যোগে এর বীজ সারাদেশে অবমুক্ত করে ছড়িয়ে দেওয়া।

বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাষ শুধু রবি মৌসুমেই (শীতকাল) হয়। কিন্তু এ পেঁয়াজ গ্রীষ্মকালীন বেশি উপযুক্ত হলেও চাষ হবে বারমাস। বারি পেঁয়াজ ওফ-৫ নামের এ পেঁয়াজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা সারাবছর উৎপাদনশীল। পেঁয়াজের উচ্চফলনশীল এ জাত উদ্ভাবন বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করেছে। একটি পেঁয়াজের ওজন ২০০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম। সর্বোচ্চ ৬ টি পেঁয়াজেই হবে এক কেজি।

বর্তমানে দেশি জাতের পেঁয়াজের হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন যেখানে ৮-১০ টন, সেখানে বারি পেঁয়াজ ওএফ-৫ উৎপাদন হচ্ছে ১৮-২৫ টন। দেশি পেঁয়াজ শুধু শীত মৌসুমেই চাষ করা হয় আর এ পেঁয়াজ চাষ করা যাবে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমেও। এ জাতটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে খুবই উপযোগী। ভাল নিষ্কাশনযুক্ত দো-আঁশ, এটেল দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ, ও পলিযুক্ত মাটি এ পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। তবে যেকোনো প্রকার মাটিতে এ পেঁয়াজ চাষ করা যায়। শুধু বারি পেঁয়াজ-৫ ই নয়, বারি পেঁয়াজ-৪ ও বারি পেঁয়াজ-৬ ও উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের জাত। এসব পেঁয়াজ চাষে সারাবছরের চাহিদা মিটবে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যমতে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে। আর দেশে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। ঘাটতি প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ। এই ঘাটতি পূরণের জন্য দেশকে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার পেঁয়াজ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মিশর সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের এ ঘাটতি থেকে উত্তরণের জন্য বারমাসি পেঁয়াজের প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়েছেন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মহব্বত উল্লাহ বলেন, 'নতুন উদ্ভাবিত বারি পেঁয়াজ ওএফ-৫ এর এ জাতটি উচ্চ ফলনশীল, বেশ ঝাঁঝালো, সারাবছর উৎপাদনশীল এবং অধিক বীজ উৎপাদনে সক্ষম। তিনি বলেন, এ পেঁয়াজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, আমাদের দেশের আবহাওয়ায় এ জাতের পেঁয়াজে ফুল হয়। যেকোনো মাটিতে এ পেঁয়াজ চাষ করা যায়। এ জাতের পেঁয়াজ জানুয়ারি মাস থেকে অক্টোবরের ২০ তারিখ পর্যন্ত রোপণ করা যায়, আমাদের আবহাওয়ায় এ জাতের পেঁয়াজের ফলন দেশী পেঁয়াজের তুলনায় অনেক বেশি ফলন হয় এবং প্রতি হেক্টরে এ পেঁয়াজের উৎপাদন ১৮-২৫ টন হয় এবং প্রতি হেক্টরে ১২শ থেকে ১৩শ কেজি বীজ উৎপাদন হয়। তিনি আরও বলেন, 'যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশে এ পেঁয়াজটি উৎপাদন করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানো।'

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলতাফ হোসেন বলেন, 'বারি ওফ-৫ জাতের এই পেঁয়াজ বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। পাশাপাশি বারি পেঁয়াজ-৪ ও বারি পেঁয়াজ-৬ ও উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের জাত। এসব পেঁয়াজ চাষ বাড়লে দেশের চাহিদার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে যখন পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন হাজার হাজার কোটি টাকার পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে যদি এ পেঁয়াজ রোপণ করা হয় তাহলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এ পেঁয়াজ উত্তোলন করা যাবে। আর দেশি পেঁয়াজের মৌসুমে জানুয়ারি-মার্চ মাসে যদি পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা যায় তাহলে সরকারের হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে। এখন শুধু সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।'

বারি সূত্রে জানা যায়, পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা ১৯৯৬ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেন। বারির সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ মহব্বত উল্লাহ ২০০১ সালে পেঁয়াজের উপর পিএইচডি গবেষণার কাজ শুরু করেন। এরপর বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ১৪ টি পেঁয়াজের জাত সংগ্রহ করে বাছাই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বারি পেঁয়াজ ওএফ-৫ নির্বাচন করেন। এই গবেষণার উপর তিনি ২০০২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করেন। এরপর গবেষণার একপর্যায়ে তিনি বছরব্যাপী উৎপাদনযোগ্য উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের অগ্রবর্তী জাত উদ্ভাবন করেন। ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জয়দেবপুরে গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। এর মাঝে গাজীপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, চট্রগ্রাম, নোয়াখালীসহ সারাদেশের ২৬৮ জন কৃষকের মাঠে এ অগ্রবর্তী পেঁয়াজের জাতটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মাঠপর্যায়ে এ পেঁয়াজের সন্তোষজনক ফলন ফলাতে সক্ষম হন।