ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

গল্পে আছেন নারী, নারীর গল্প নেই

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩, ০২:০২ রাত  

তাসনিম জাহান তাজিন, ঢাকা থেকেঃ সিনেমার পর্দায় নারীর উপস্থিতি থাকলেও গল্প জুড়ে নেই নারীর স্বতন্ত্র ভূমিকা।পুরুষকে বিনোদন দিতে অথবা সিনেমার পুরুষ চরিত্রটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে — এভাবেই করা হয় নারীর চরিত্রায়ণ।কয়েক যুগেও খুব বেশি বদলায়নি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান।

ভাবুন তো! বাণিজ্যিক ধারার একটি বাংলা ছবি জুড়ে নায়িকার গুণ ও প্রতিভায় সয়লাভ।নায়িকাকে কেন্দ্র করেই গল্প, নায়ক ও অন্যান্য চরিত্র।এমন ভাবনা যেন আষাঢ়ে গল্প।বাস্তবে, কমার্শিয়াল ছবি মানেই নায়িকা ব্যবসার পুঁজি ও লগ্নি।অভিনয়ের সুযোগের চেয়ে অভিনেত্রীর শরীরি আবেদনই মুখ্য থাকে বাণিজ্যিক ধারায়।নায়ককে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খায় নায়িকা ও অন্যান্য নারী চরিত্রের গল্প।এসব চলচ্চিত্রে ভায়োলেন্স ও সেক্স সিনেমার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।নারী চরিত্রকে দূর্বলভাবে চরিত্রয়ায়ণ করে তথাকথিত পুরুষত্ব পর্দা জুড়ে দেখানো হচ্ছে বহুদিন ধরে।এসবের আড়ালে, চাপা পড়ে যায় মানুষ হিসেবে নারীর ভূমিকা।পুরুষ চরিত্রের পাশে নারীকে উপস্থাপন করা হয় বস্তু হিসেবে।আর্ট ফিল্ম বা বিকল্প ধারার ছবি হিসেবে পরিচিত সিনেমাগুলোতেও দেখা মেলে না মানুষ কিংবা অভিনেত্রী হিসেবে নারীর উপস্থাপন।চলচ্চিত্রকার আকরাম খান বলেন, ‘তথাকথিত এসব আর্টফিল্মে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যৌনবস্তু হিসেবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে নারীকে।শুধুমাত্র শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত দর্শকদের জন্য উপস্থাপনের ধরন বাণিজ্যিক ধারার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।অপ্রয়োজনীয়ভাবে গল্পের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে অভিনেত্রীর যৌন আবেদন পূর্ণ দৃশ্য।এসব কারণে নারীদের গল্প সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যাচ্ছে না।’

নারীদের গল্প সাবলীল ভাবে পর্দায় ফুটে না উঠার পিছনে পরিচালকের দায় কতোটুকু, জানতে চাইলে ঘাসফুল, খাঁচা সিনেমার নির্মাতা বলেন, ‘ নারীদের কথা সবসময় সমাজে চাপা পড়ে ছিল।নারীদের বুঝতে হলে, সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে চাইলে অনেক বেশি পড়াশোনা, গবেষণার প্রয়োজন।হৃত্তিক ঘটক, সত্যজিত রায় যেভাবে মন প্রাণ দিয়ে সিনেমা করেছেন, নারীকে সংবেদনশীল ভাবে দেখেছেন সেই চর্চা এখন অনেক কম।’আবার অনেক সময় নারীদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে চাইলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চাপে তা সম্ভব হয় না।ব্যবসায়িক স্বার্থে নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করতেই চাপ দেয় এসব প্রতিষ্ঠান।কেননা, বহুকাল ধরে পুরুষ দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারেই হয়ে আসছে সিনেমায় নারীর উপস্থাপন।

চলচ্চিত্রে নারীর সঠিক উপস্থাপনে দর্শকই যেন অনেক বড় বাঁধা।সিনেমা কখনোই একপাক্ষিক বিষয় নয়।দর্শকের চাহিদা, পছন্দের উপর নির্ভর করেও অনেকাংশে চলচ্চিত্র বানাতে হয় নির্মাতাদের।বহুকাল ধরেই চলচ্চিত্রের দর্শক হিসেবে পুরুষরাই জায়গা করে নিয়েছে।কয়েক দশক আগে সিনেমা হলে যেমন নারী দর্শক যেতেন এখন তাও নেই।নারী, পুরুষ দর্শকের মাঝেই নারীকে পুরুষের সেবিকা বা প্রেমিকা হিসেবে দেখার প্রবণতাই বেশি।তবে দর্শকদের এমন চাহিদা তৈরি হবের পেছনে রাষ্ট্র,সমাজ সবার ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন আকরাম খান।জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত এনির্মাতা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নারীকে ভুলভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে।দর্শকের নেতিবাচক মানসিকতা একদিনে তৈরি হয়নি।তাছাড়া দর্শক কে সুস্থ বিনোদন, চিন্তার খোরাক দিতে রাষ্ট্র সুশিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতি দিতে দায়বদ্ধ।’

তবে হাজারো সমস্যার মাঝেও রয়েছে আশা জাগানিয়া বিষয়।চলচ্চিত্র নিয়ে নতুনভাবে ভাবা হচ্ছে।সেখানে যুক্ত হয়েছে অনেক তরুণ নির্মাতা যারা পর্দায় নারীকে সহজ, সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করতে চান। অনেক দর্শকের মধ্যে এখন নারী প্রধান ছবির চাহিদা তৈরি হয়েছে।বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছেন বেশ কজন তরুণ নারী নির্মাতা।প্রতিষ্ঠিত তরুণ নারী নির্মাতা অপরাজিতা সংগীতা অনেকদিন ধরে সিনেমার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন নারীদের নিয়ে।তিনি বলেন, ‘মানুষের কাছে সহজে পৌঁছানোর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম এখন চলচ্চিত্র।নারীরা নির্মাতা হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হলে সিনেমায় নারীর উপস্থাপন অনেক ইতিবাচক হয়ে উঠবে।পুরুষরা অনেক সময় তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে নারীকে দেখতে পারেন না।নারী নির্মাতারা অনেক গভীরভাবে নারীদের গল্প পর্দায় তুলে আনতে পারেন।’

তবে বাংলাদেশের মিডিয়ায় নির্মাতা হিসেবে নারীর আসীন হওয়া সহজ নয়।এসম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অপরাজিতা বলেন, ‘পুরুষ পরিচালকদের সহকর্মীরা যেভাবে মেনে চলেন, সম্মান দেন নারী পরিচালকদের বেলায় অনেক সময় সেটা দেখা যায় না।আমাদের সমাজ এখনো নারীর নির্দেশ শুনতে অভ্যস্ত নয়।চলচ্চিত্রকে সামগ্রিক ভাবে আরো শক্তিশালী করতে নারী নির্মাতাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।তাহলে আরো নারী নির্মাতাই এগিয়ে আসবেন।’তবে নারী নির্মাতা বা নারী প্রাধান্য দেওয়া সিনেমায় বেশিরভাগ সময় নারীর বিপ্লবী চরিত্র কিংবা নারীর বৈষম্যের কথাই তুলে ধরা হয়।নির্মাতা আকরাম খান মনে করেন, চলচ্চিত্রে নারীর আরো বিস্তৃত বিচরণ গড়ে উঠা প্রয়োজন।বাণিজ্যিক,সামজিক যেকোনো ধরনের সিনেমায় যেকোনো নারী চরিত্রের স্বাধীন উপস্থাপন পর্দায় তুলে ধরতে হবে।’গ্রামীণ সরল নারী থেকে আধুনিক সচেতন নারী সবারই পৃথিবীর পথে বিচরণ আছে, নিজস্ব চিন্তা আছে সেই গল্প যেন হারিয়ে না যায়!