নওয়াজকে হারিয়ে যেভাবে সরকার গঠন করতে পারে ইমরানের অনুগতরা
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪, ০৪:২২ দুপুর
ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানের কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটির সদ্যসমাপ্ত ১৬তম সাধারণ নির্বাচনে জয় দাবি করেছেন এবং তার কর্মী-সমর্থকদেরকে এই বিজয় উদযাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মূলত এই নির্বাচনে পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অন্য সব রাজনৈতিক দলকে আসনের সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছে। তবুও এখন যে প্রশ্ন বেশ বড়সড় ভাবে সামনে আসছে, তা হলো- স্বতস্ত্র প্রার্থীরা পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে একত্রিত হতে পারে কিনা। রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।
ইমরানের দলের নেতা ব্যারিস্টার গহর আলী খানের মতে, পিএমএল-এন-এর পক্ষে নির্বাচনী ফলাফলে কারচুপির আগে পিটিআই জাতীয় পরিষদের ১৭০টি আসনে এগিয়ে ছিল। তিনি বলেছেন, তার দল এই কারচুপির বিরুদ্ধে আইনিভাবে এগোবে।
ব্যারিস্টার গহরের এই বিবৃতি এমন এক সময়ে সামনে এসেছে যার একদিন আগেই পিএমএল-এনের শীর্ষ নেতা নওয়াজ শরিফ নির্বাচনে জয় দাবি করেছেন। নিজের বিজয়ী বক্তৃতায় শরিফ দাবি করেছেন, পিএমএল-এন ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্র ও পাঞ্জাবের একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
কৌশলগতভাবে নওয়াজ সঠিক কথাই বলেছেন। কারণ তিনি দাবি করেছেন, পিএমএল-এন নির্বাচনের পরে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এর কারণ হলো, ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) দল হিসাবে বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাদের নির্বাচনী প্রতীকও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আর তাই ইমরানের দলের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের মোট আসন সংখ্যা ২৬৬টি। এর মাঝে ২৫৬টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন বলেছে, ফলাফল ঘোষণা করা ২৫৬টি আসনের মধ্যে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দলের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০০টি আসনে জয়ী হয়েছেন। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৩টি আসনে জয় পেয়েছে।
এছাড়া প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টিও ৫৪টি আসনে জয় পেয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বাকিগুলো ছোট কিছু দল জিতেছে।
আর ৭০টি সংরক্ষিত আসনসহ পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে মোট আসন সংখ্যা ৩৩৬টি। সব মিলিয়ে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য কোনও একটি দলকে জাতীয় পরিষদে কমপক্ষে ১৬৯টি আসন থাকতে হবে।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সির (পিআইএলডিএটি) সভাপতি আহমেদ বিলাল মেহবুব বলেছেন, পিএমএল-এন বা পিপিপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জোট গঠন না করে স্পষ্টতই পিটিআই সরকার গঠনের মতো অবস্থানে নেই। কারণ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন তারা পায়নি।
সংরক্ষিত আসনের হিসাব আপাতত বাদ দিলে পাকিস্তানে সরকার গঠন করার জন্য কোনও দলকে ন্যূনতম ১৩৪টি আসনে জয়লাভ করতে হবে। কিন্তু দেশটির নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত যে ২৫৬টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে কোনও দলই এককভাবে এতো বিপুল সংখ্যক আসন পায়নি।
এমনকি বাকি আসনগুলোর ফলাফলও যদি কোনও একক দলের পক্ষে যায়, তারপরও তা সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন হবে না। আর এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আসনের দিক থেকে এগিয়ে। এদের মাঝে ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীই বেশি।
পাকিস্তানের সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার তিনদিনের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জানাতে হবে, তারা কোনও দলে যোগ দেবেন নাকি স্বতন্ত্র হিসাবেই থাকবেন।
এমন অবস্থায় পিটিআই-অনুমোদিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন-পরবর্তী তিন দিনের সময়ের মধ্যে পিটিআইতে আবারও যোগ দিতে চাইলে কী হবে? আহমেদ বিলাল মেহবুব বলেছেন, এটা সম্ভব। তবে মেহবুব ব্যাখ্যা করেছেন, এটি তাদের জন্য বেশ দীর্ঘ একটি পথ হবে। কারণ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে দলে যোগ দিতে চান তাদের অবশ্যই একটি দলীয় প্রতীক থাকতে হবে, আর এটি বাধ্যতামূলক।
তাই তিনি বলেন, তারা (স্বতন্ত্র প্রার্থীরা) আবার পিটিআইতে যোগ দিতে চাইলে পিটিআইকে আন্তঃদলীয় নির্বাচন করতে হবে এবং তাদের প্রতীক বা অন্য কোনও প্রতীক ফিরে পেতে হবে। আর এটি হলে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সংরক্ষিত আসনও পাবে পিটিআই।
তিনি আরও বলেছেন, ২০১৭ সালের ইসিপি বিধির ৯৪ বিধিতে দলীয় প্রতীক থাকার শর্তটি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা এমডব্লিউএমের মতো অন্য নিবন্ধিত দলগুলোতে যোগ দিতে পারে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মেহবুব ইতিবাচকভাবে উত্তর দেন। তিনি বলেন, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা এমডব্লিউএম বা অন্য যে কোনও দলে যোগ দিতে পারেন।
আহমেদ বিলাল মেহবুব বলছেন, যদি তারা সেটি করেন তাহলে তারা সেই দলের শৃঙ্খলা মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা যদি এমডব্লিউএম বা অন্য কোনও দলে যোগ দেয়, তাহলে তারা জাতীয় পরিষদে তাদের মোট আসন সংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত আসন পেতে পারে।
তেমনটি হলে মোটামুটিভাবে তারা ২৫ থেকে ২৭ আসন পেতে পারে যদি তাদের মোট আসন ১০০টির কাছাকাছি থাকে।
মেহবুব বলেন, এমডব্লিউএম-এ যোগদানের পর সংরক্ষিত আসন পেতে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের ইসিপিতে হলফনামা জমা দিতে হবে যে তারা এমডব্লিউএম বা অন্য কোনও দলে যোগ দিচ্ছে। পরবর্তীতে এমডব্লিউএম বা তারা যে দলে যোগদান করবে তার প্রধানকে ইসিপিকে লিখিতভাবে জানাতে হবে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, ইসিপি ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এটি হতে পারে।
এছাড়া এমডব্লিউএম সবচেয়ে বেশি আসন পেলে সরকার গঠন করতে পারবে কিনা জানতে চাইলে মেহবুব আবারও ইতিবাচক জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘একটি সরকার গঠন বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার জন্য একটি দলকে জাতীয় পরিষদে কমপক্ষে ১৬৯টি আসন থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, প্রশ্ন উঠছে, পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের বর্তমান আসন সংখ্যা ১০০টির কাছাকাছি হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের এই সংখ্যাটি কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে। আর তাই তিনি আরেকটি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন যেখানে পিটিআই সরকার গঠন করতে পারে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার সময় যদি কেউ প্রথম দফায় জাতীয় পরিষদের ৩৩৬ আসনের মধ্যে ১৬৯টির ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে সেদিন হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে কেউ তাদের পছন্দের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে বা সরকার গঠন করতে পারে।
মেহবুব বলেন, ‘দ্বিতীয় রাউন্ডে যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তারা তাদের পছন্দের প্রধানমন্ত্রী পেতে পারেন বা সরকার গঠন করতে পারেন।’
পিটিআই-সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা স্বতন্ত্র ব্লকে একত্রিত হলে তারা কী ভূমিকা পালন করতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংরক্ষিত আসন পাবে না এবং ৭০টি সংরক্ষিত আসন জাতীয় পরিষদে দলভিত্তিক শক্তিমত্তা বিবেচনায় অন্যান্য দলকে দেওয়া হবে।
তবে তিনি বলেন, পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা কোনও দলে যোগ না দিলেও তারা জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ পেতে পারেন। এর জন্য তাদের জাতীয় পরিষদের স্পিকারের কাছে একটি আবেদন জমা দিতে হবে যে, তারা তাদের মনোনীত কোন একজন প্রার্থীকে সমর্থন করেন।