জাতীয় নির্বাচন ২০২৪
দুর্গে দুর্গতি জাতীয় পার্টির, জয় মাত্র ৩টিতে
প্রকাশিত: জানুয়ারী ০৯, ২০২৪, ১২:২০ রাত
ছবি সংগৃহীত
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের দুর্গে চরম ভরাডুবি হয়েছে জাতীয় পার্টির (জাপা)। নানা নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেও পরাজয় ঠেকাতে পারেনি দলটির বেশির ভাগ প্রার্থী। বিশেষ করে নৌকা না থাকা ২৬টি আসনে সমঝোতার পরও মাত্র ১১টিতে জয় পেয়েছে জাতীয় পার্টি। অন্য সব আসনের অধিকাংশতেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীদের।
আসন সমঝোতার ২৬ আসনের মধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল ৯টি। এর মধ্যে মাত্র ৩টি আসনে জিততে পেরেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। তারা হলেন— রংপুর-৩ আসনে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান।
বাকি ছয়জনের কেউই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি। নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল, নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমান, রংপুর-১ আসনে হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ, কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা-১ আসনে শামীম পাটোয়ারী এবং গাইবান্ধা-২ আসনে মো. আব্দুর রশিদ সরকার হেরে গেছেন।
রংপুর বিভাগের আট জেলার ৩৩টি আসনের মধ্যে তারা মাত্র এই ৩টিতে জয় পেয়েছে। এসব আসনে নৌকা প্রতীক ছিল না বলেই জয় এসেছে। না হয় এগুলোতেও পরাজয় হতে পারত বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদবিহীন এ দলের এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে দলের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত তারা।
রংপুর জেলায় গত নির্বাচনে দুজন জয়ী হলেও এবার জাতীয় পার্টি থেকে কেবল জি এম কাদের জিতেছেন।
তিস্তা নদীবেষ্টিত গঙ্গাচড়ায় নৌকার প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রের কাছে নাস্তানুবাদ হয়েছেন এরশাদের ভাতিজা এবং সাবেক সংসদ সদস্য হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ ও বর্তমান সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ।
স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘ ৩৭ বছর পর নাড়ির টানে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পেরেছেন তারা। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়ের মধ্য দিয়ে এ আসনে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ দুমড়ে-মুচড়ে পড়বে বলে মনে করছেন অনেকে।
লালমনিরহাটের তিনটি সংসদীয় আসন একসময় জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর সেই দুর্গ ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এই দুর্গে এখন শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে আওয়ামী লীগ। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছে। তিন আসনেই নৌকা জিতেছে। জাতীয় পার্টির কর্মীরা এখন হতাশ হয়ে বিভিন্ন দলে ভিড়ছেন। তাদের মতে, নিজেদের দুর্গেই দুর্গতিতে পড়েছে জাতীয় পার্টি।
গাইবান্ধাও একসময় জাতীয় পার্টির দুর্গ ছিল। দিনে দিনে সেই দুর্গে চরম দুর্দিন নেমে এসেছে। এবার এ জেলার পাঁচটি আসনের দুটিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হলেও কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে সংসদে দাঁড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও আব্দুর রশিদ সরকারের। বাকি তিনটি আসনে নৌকার কাছে পাত্তাই পায়নি জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
একই চিত্র নীলফামারীতেও। এ জেলার চারটি আসনেই ভরাডুবি হয়েছে জাতীয় পার্টির। এরশাদ পরিবারের সদস্য ও বর্তমান এমপি আহসান আদেলুর রহমানকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও জয়ের মালা গলায় তুলতে পারেননি তিনি। নীলফামারীর চারটি সংসদীয় আসনের দুটি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক ও দুটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল এবং নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমানকে ছাড় দিয়ে ওই দুটি আসনে নৌকা রাখেনি আওয়ামী লীগ। তারপরও জিততে পারেননি জাতীয় পার্টি।
এদিকে কুড়িগ্রামের চারটি সংসদীয় আসনের একটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বাকি তিনটির দুটিতে আওয়ামী লীগের নৌকা ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। এ জেলার দুটি আসনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে ছাড় দিলেও জিতেছেন কেবল কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মুস্তাফিজুর রহমান। ছাড় পাওয়া আরেক প্রার্থী পনির উদ্দিনের ভরাডুবি হয়েছে।
ভোট বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমঝোতার আসনগুলোর মধ্য থেকেই ১১টিতে জয়ের দেখা পেয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। বাকি কোথাও তারা জিততে পারেননি। এমনকি কোথাও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়তে পারেননি।
আওয়ামী লীগ ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও ভোটে জিততে না পারাকে বড় ধরনের ব্যর্থতা বলে মনে করছে জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বছরের পর বছর সমঝোতার রাজনীতি করতে গিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়ার ফলেই এমন ভয়াবহ ভরাডুবির শিকার হতে হয়েছে বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
সারা দেশে জাতীয় পার্টির হাতেগোনা কয়েকজন নেতার জয় ছাড়া বেশির ভাগ নেতার অসহায় পরাজয় হয়েছে। জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার তালিকায় থাকা সবচেয়ে বেশি প্রার্থীও এই দলটির। এমন পরাজয়ের নেপথ্যে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ জনগণের মতামতের মূল্যায়ন না করাকে দুষছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই সেই চিত্র প্রকট হয়ে উঠছিল।
কার নেতৃত্বে দল নির্বাচনে যাবে, আদৌ যাবে কি না— এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয় প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত। ওই দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ভোটেই আসেননি। ভোট করেননি এরশাদের মৃত্যুতে শুন্য আসনে উপনির্বাচনে জয়ী হওয়া তার ছেলে সাদ এরশাদও।
জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রথম নির্বাচনী জোট হয় ২০০৮ সালে। ওই নির্বাচনে মহাজোট সঙ্গী জাতীয় পার্টিকে ৩২ আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। আর উন্মুক্ত ১৭টি আসনে উভয় দলের প্রার্থীরা নিজ নিজ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০ আসনে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ১৩ আসনে বিজয়ী হন।
এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয় ২৯টি আসন। তারা শেষ পর্যন্ত ২২টি আসনে জয়লাভ করে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠে। এবার ১১টি আসন দিয়ে জাতীয় পার্টি কেমন বিরোধী দল হবে, সেই প্রশ্ন যেমন দেখা দিয়েছে তেমনি দুর্গখ্যাত রংপুরের রাজনীতিতে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না সেটিও এখন দেখার বিষয়।
প্রসঙ্গত, এবার জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল। ১১ জন প্রার্থী নিজে থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ের পর শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন ২৬৫ জন প্রার্থী। তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দল থেকে সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার কারণে নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ১৯ জন সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত ভোটে ছিলেন ২৪৬ জন।