ঢাকা, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচলিত আইনেই বাঁধা নারীর সম্পদের অধিকার

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩, ০২:০৬ রাত  

তাসনিম জাহান তাজিন, ঢাকা থেকেঃ এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে কুমিল্লার শতবাড়িয়া গ্রামে পারভিন বেগমের সংসার।দরিদ্র পরিবারে একমাত্র অবলম্বন পারভিন বেগমের স্বামী মারা যাবার পর অস্বচ্ছলতা এখন নিত্যসঙ্গী। অন্যদিকে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শশুর বাড়ির আত্মীয়রা।সম্পত্তি বাঁচাতে দুবছর ধরে মামলা চললেও এখনো পাননি আশাপূর্ণ ফলাফল।উল্টো ভিটেমটি ছাড়তে হুমকি ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েকবার।

স্বামী ও বাবার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া সম্পদে স্ত্রী ও মেয়ের অধিকার থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন বাংলাদেশের নারীরা।শুধুমাত্র গ্রামেই নয়, এই ভোগান্তি থেকে বাদ যান না শহরের নারীরাও।বাংলাদেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন পরিচালিত হয় মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী।এআইনে বাবার মৃত্যুর পর, পরিবারে ছেলে সন্তান না থাকলে একজন মেয়ে সন্তান পাবেন সম্পদের দুই ভাগের এক ভাগ।দুজন মেয়ে হলে পেয়ে থাকেন মোট সম্পদের তিন ভাগের দুই ভাগ।স্বামী মারা যাবার পর স্ত্রী পেয়ে থাকেন মোট সম্পদের আট ভাগের এক ভাগ।নির্ধারিত একটি অংশ মৃতের ভাই এবং আত্মীয়রা পাওয়ার পরও নারীদের প্রাপ্য অংশ দিতে অবহেলা ও নারাজ অধিকাংশ পরিবার।

নুজহাত তাবাসসুম পড়াশোনা করছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।বাবার মৃত্যুর পর ছোট ভাই ও নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার।তিনি জানান, ২০১৭ সালে একটি দূর্ঘটনায় তার বাবা মারা যায়।মৃত্যুর পর বাবার বাড়ির আত্মীয়রা ছেলে সন্তান নাবালক হবার অযুহাতে বুঝিয়ে দেননি সম্পত্তির ভাগ।অন্যদিকে মেয়ে সন্তান হিসেবে শিক্ষিত ও প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নুজহাত।এই নিয়ে চার বছর ধরে আইনি প্রক্রিয়া চললেও এখনো ফলাফল পায়নি তার পরিবার।বরং সম্মুখীন হয়েছে প্রশাসনিক অবহেলা ও পুলিশি হয়রানির।

উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবার কারণ হিসেবে অনেকে উল্লেখ করছেন প্রচলিত সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইনকেই।ভুক্তভোগী নুজহাত তাবাসসুম বলেন, প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইনে সম্পদে নারীদের সমঅধিকার নেই।পরিবারে ছেলে সন্তান না থাকলে বাবার সম্পদে হস্তক্ষেপ করতে পারেন চাচা ও চাচাতো ভাইরা।এখান থেকে সম্পদ বণ্টনের সময় মেয়েদের গুরুত্ব না দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠেছে।পরিবারে সাবালক ছেলে সন্তান না থাকলে সম্পদ বণ্টনে বিলম্ব করা, হুমকি, সম্পদ জালিয়াতি বিভিন্ন ভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন আত্মীয়রা।এছাড়া প্রচলিত আইনটি যুগোপযোগী নয় বলেও মনে করেন তিনি।তিনি বলেন, বাবা বা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়।এঅবস্থায় শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান বলে বাবার সম্পদের সম্পূর্ণ অংশ না পাওয়া অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।এছাড়া বঞ্চিত সম্পদের জন্য মামলা করলে দীরমেয়াদি আইনি প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক হুমকি,পুলিশি হয়রানি ও দূর্নীতি নারীর সম্পদের অধিকার নষ্ট করছেন বলে জানান অনেকে।

নারীরা যেন উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য বিভিন্ন সময়ে সম্পদ বণ্টনে নারী পুরুষের সমান অধিকার এর দাবী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা।সম্পদ বণ্টনে দূর্নীতি ও আইনি জটিলতা এড়াতে আইন সংশোধন কে সমাধান হিসেবে দেখছেন তারা। তবে আইনে কেন নারীদেরকে কেন সম্পদ বণ্টনে পুরুষের তুলনায় সমান অধিকার দেয়া হয়নি জানতে চাইলে আইনজীবি হিমেল মামবুব জানান ,মুসলিম আইনে সাধারণত পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বেশি সম্পত্তির অংশ পেয়ে থাকেন। এর কারণ হিসাবে দেনমহরানা বা তাদের ভরণপোষণ সাধারণত পুরুষেরাই বহন করে দ্বিতীয়ত, নারী শুধু বাবা-মা থেকে সম্পদ পায় না আরও অনেক খাত থেকে তারা সম্পদ পায়। বাংলাদেশ আইন অনুয়ায়ী একজন নারী তার –মাতা, দাদা, স্বামীর নিকট থেকেও কিন্তু সম্পত্তির একটা অংশ পেয়েই থাকেন।

প্রাপ্য সম্পদ না পেলে নারীরা কি কি আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন বা কি কি আইনি সহায়তা পেতে পারেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,কোনো নারীকে যদি তার প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় তবে তিনি এটা নিয়র হাইকোর্টে বন্টন মামলা করতে পারবেন তার ফলে কিন্তু তারা তাদের প্রাপ্য সম্পত্তি টুকু পেতে পারেন যদিও বেশির ভাগ নারী নানা সামাজিক চাপে এসব মামলা থেকে দূরে থাকেন যার ফলে তারা প্রতিনয়ত তাদের প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়া ও অসংখ্য আইন রয়েছে যা তাদের প্রাপ্য আইনটুকু আদায়ে সহযোগিতা করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে দেখা যায় মূলত সামাজিক চাপের কারনেই তারা বেশির ভাগ সময় আইনী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন।

সম্পদ বণ্টনে দূর্নীতি ও আইনি জটিলতা এড়াতে আইন সংশোধন কে সমাধান হিসেবে দেখছেন তিনি। তিনি জানান, বাংলাদেশ একটি ইসলামিক দেশ সুতরাং এখানে মুসলিম সুন্নি আইন দ্বারাই এখানে সম্পত্তির বন্টন করা হয়ে থাকে। আর এখানে কোনো স্বাধীন আইন প্রনয়ন করা হয় নি। তাই যদি কোনো স্বাধীন আইন প্রনয়ন করা সম্ভব হয় তবে হয়তো অনেক অংশে আইন জটিলতা এড়ানো সম্ভব। এছাড়া নারীদের অধিকার যতটুকু ইসলাম দিয়েছে ততটুকুও তারা অনেক ক্ষেত্রে আদায় করতে পারেন না। অর্থাৎ, নারীর প্রাপ্য অধিকারের অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই আইন প্রণয়নের পাশাপাশি এর বাস্তবায়নেও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।