ডিগ্রিতে পড়ে প্রথম বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডার
প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৩, ০১:২৮ দুপুর
ছবি সংগৃহিত
ডিগ্রিতে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ঘটনা বিরল। বিগত বিসিএসগুলোতে হাতে গোনা যে কয়জন ডিগ্রি পাস প্রার্থীবিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শেখ তৌহিদুল কবীর একজন। তিনি ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তহয়েছেন। তাঁর চাকরি পাওয়ার গল্প শুনেছেন এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
বেড়ে ওঠা রাজশাহী সদরেই। বাবা শেখ রেজাউল করিম ও মা নাজমিনা বেগম। আমরা দুই ভাই। আমি ছোট।
২০০৮ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করার পর প্রথমবার ভর্তিযুদ্ধে ব্যর্থ হই। এ সময় বাবার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। জীবনের সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়। ২০১১ সালে বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান।
এরপর সিদ্ধান্ত নিই ডিগ্রিতে (পাস কোর্স) ভর্তি হওয়ার। ২০১১ সালে এই কোর্সে ভর্তি হই রাজশাহী কলেজে। অনেকের কাছে কটুকথা শুনতে হয়। তার পরও আমি দমে যাইনি।নিজের মধ্যে এক অদম্য ইচ্ছা তৈরি হয় কিছু করে দেখানোর।
ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমি আমার চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। এ ক্ষেত্রে আমার বড় ভাই আমার মেন্টরেরভূমিকা পালন করেন। মূলত বড় ভাইয়ের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার বিসিএসের পথচলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেবলে আমি বিশ্বাস করি। ২০১৪ সালে ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সেশনজটের কারণে ডিগ্রি শেষ হয় ২০১৬ সালে।
ডিগ্রিতে রাজশাহী কলেজে বিএসএস থেকে মেধাক্রমে তৃতীয় হয়েছিলাম। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্সফাইনাল সম্পন্ন করার পর আমি চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু করি। ডিগ্রি থেকে প্রস্তুতি শুরু করার কারণে এ সময় নিজের মধ্যেএকটা আত্মবিশ্বাস কাজ করে। মাস্টার্স শেষ করার পর আমার হাতে তিন বছরের মতো সময় অবশিষ্ট ছিল। ২০১৮ সালেপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে আবেদন করি।
২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে যোগ দিই। ওই সময় ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়, আবেদন করি। ৪১তম বিসিএস ছিল জীবনের প্রথম বিসিএস। এর মধ্যে ২০২২ সালে আমি হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়েঅডিটর পদে নিয়োগ পাই। বর্তমানে আমি এখানেই কর্মরত। ডিগ্রিতে পড়ার সময় আমার প্রস্তুতি ছিল প্রিলিমিনারিভিত্তিক।প্রিলির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমার দুর্বল দিকগুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান হই। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি ভীতি কাজ করত। এজন্য আমি গণিতের প্রতি বাড়তি নজর দিই। এ ছাড়া অন্য বিষয়গুলোকেও প্রাধান্য দিই। কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে নিয়মিতক্লাস-পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিতাম, যা আমার প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
২০২১ সালে ৪১তম বিসিএস প্রিলি অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, যা আমার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এরপরলিখিত প্রস্তুতি শুরু করি। লিখিত প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমি বাজারের প্রচলিত গাইড বইয়ের পাশাপাশি নিয়মিত অনুবাদ চর্চাকরতাম। এখানেও আমি গণিতে আলাদা নজর দিই। বিভিন্ন ধরনের ডাটা আমি আলাদা খাতায় লিখে রাখতাম। আমারহাতের লেখার ধীরগতির কারণে আমি কোনো একটি বিষয় পড়ার পর তা খাতায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেখার প্র্যাকটিসকরতাম। আমি মনে করি, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় টাইম ম্যানেজমেন্ট একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করেবাংলা, বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান—এগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরো প্রশ্ন কাভার করতে পারলে তাআপনার নম্বরপ্রাপ্তিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে। ইংরেজির জন্য ফ্রিহ্যান্ড লেখার চর্চা করতাম। গাইড বইয়ের মডেল প্রশ্নথেকে passage চর্চা করতাম। লিখিত পরীক্ষায় আমি কোনো বিষয়েই মুখস্থনির্ভর পড়িনি। সব বিষয়েই ধারণা নিয়ে সে বিষয়েলেখার চেষ্টা করেছি। মূলত লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি হতে হবে পরিকল্পনামাফিক।
সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারলে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। ২০২২ সালেরনভেম্বরে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। রেজাল্ট শিটে আমার রোল দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়।এরপর শুরু হয় আমার ভাইভা প্রস্তুতি। ভাইভার জন্য শুরুতে আমি ‘ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি’ বইটি সংগ্রহ করি। এই বইটিআমাকে ভাইভা প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হবে এটি বুঝতে বেশ সহায়ক হয়েছে। আমি বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয়ে ধারণা নেওয়ার চেষ্টাকরি। প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স থেকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর তথ্য একটি খাতায় নোট করি। এছাড়া নিজের পঠিত বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে পড়াশোনা করি। যেহেতু আমার প্রথম পছন্দ ছিল প্রশাসন, তাই প্রশাসনসম্পর্কেও ধারণা নিই। বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই পড়ি। আমি মনে করি, চাকরিপ্রত্যাশীদের বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই অবশ্যই পড়াউচিত। আমার ভাইভা পুরোটাই বাংলায় হয়। অনেকের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে যে ভাইভা বোর্ডে জাতীয়বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। এটি একটি ভুল ধারণা। আমার কাছেএকবারের জন্যও এমনটি মনে হয়নি। বোর্ডের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করে। যেসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না সে ক্ষেত্রেবিনয়ের সঙ্গে স্যরি বলি। ভাইভা বোর্ডে বিনয়ী আচরণ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ভাইভা বোর্ড দেখে কিভাবে আপনি পরিস্থিতিসামাল দিচ্ছেন।ভাইভা শেষ করে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়। অবশেষে আগস্টের ৩ তারিখ আমার অপেক্ষার পালা শেষহয়। প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
২৪ ঘন্টা আপডেট নিউজ পেতে bdtribune24/বিডিট্রিবিউন২৪ এর ফেসবুক পেজ ফলো করুন
আমি মনে করি, বিসিএস যতটা না মেধার পরীক্ষা, তার চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্য আর একাগ্রতার পরীক্ষা। যিনি একাগ্রচিত্তেলেগে থাকতে পারবেন, তিনি অবশ্যই সফল হবেন বলে আমি মনে করি। বিশ্বাস রাখতে হবে যে ‘আমিও পারব’। ব্যর্থতাআসবেই, কিন্তু তাতে ভেঙে পড়লে চলবে না। বিসিএসে সফলতা পেতে পরিশ্রম করতে হবে। এই পরিশ্রম হবে পরিমিত, কিন্তুঅবশ্যই নিয়মিত।