ফুড কার্ভিংয়ে মাসে লাখ টাকা আয় ফারদিনের, কোনো মাসে ৪-৫ লাখ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৪, ০৮:০০ রাত
ছবি সংগৃহীত
চোখের দৃষ্টি শুধুই হাতে রাখা সবজি কিংবা ফলের ওপর। যেন এক মুহূর্তের জন্যও অন্য কোথাও তাকানোর সুযোগ নেই। নিপুণ হাতে ছোট ছোট ছুরি-কাঁচির সাহায্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিটরুটের আকৃতি পেলো আস্ত একটি গোলাপ। হাতের পেয়ারাটি হয়ে উঠলো সুন্দর ফুল।
এভাবে ফুড কার্ভিং করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন শরীয়তপুরের যুবক ফারদিন খান। শুধু কি তাই? ভিন্নধর্মী এ পেশা থেকে তার মাসিক আয় এখন লাখ টাকার ওপরে।
ফুড কার্ভিং আর্টিস্ট ফারদিন খানের বাড়ি শরীয়তপুরের পালং ইউনিয়নের আটিপাড়া এলাকায়। আব্দুর রব খান ও আফরোজা খানম দম্পতির ছোট সন্তান তিনি। পড়াশোনা করছেন শরীয়তপুর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল ফারদিনের। এ আঁকাআঁকিকে ফুটিয়ে তোলা শুরু করেন বাজার থেকে কিনে আনা বিভিন্ন সবজির ওপর। তবে এসবে বাঁধ সাধেন বাবা রব খান। তার ধারণা, এসব কাটাকুটির কাজ মেয়েদের। তাই চাইতেন না তার ছেলে মেয়েদের কাটাকুটির কাজ করুক। এসব থেকে দূরে রাখতে রীতিমতো রাগারাগি করেও থাকতেন তিনি।
তবে ফারদিন নাছোড়বান্দা। বাবার ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে চালিয়ে যেতেন তার এ শিল্পকর্ম। সব চড়াই-উতরাই পার করে একসময়ে বড় দুই বোন আর মায়ের সাপোর্ট পেয়ে তিনি তার এই প্রতিভাকে আরও বিকশিত করতে থাকেন।পরের ঘটনা ২০১৭ সালে জুনে। বোনের বিয়েতে সুন্দর একটি ফুড কার্ভিং করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। তার এ কাজে মুগ্ধ হয়ে বাহবা দিতে থাকেন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আত্মীয়-স্বজনরা। অনেকেই তখন তাকে এই ফুড কার্ভিংকে ব্যবসা হিসেবে নিয়ে পরিধি বাড়াতে বলেন। ফারদিনও তাই করেন।
২০১৮ সালে একটি ফেসবুক পেজ খুলে সেখানে তার বিভিন্ন ফুড কার্ভিংয়ের ভিডিও আপলোড দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ডার আসা শুরু করে। এ থেকেই রীতিমতো রোজগার হওয়া শুরু হয় তার। বর্তমানে এ ফুড কার্ভিং থেকে তার প্রতিমাসে আয় এখন লাখ টাকা ওপরে।
ফারদিন জানান, তিনি তার এ ফুড কার্ভিং করতে সবজির মধ্যে ব্যবহার করেন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, পেঁপে, গাজর, শালগম, বিটরুট, ক্যাপসিকাম, লেটুস পাতা, টমেটো ইত্যাদি। আর ফলের মধ্যে তরমুজ, আপেল, আঙুর, পেয়ারা, এমনকি কাঁঠালও। সবজি আর ফলের বাইরে নকশা ফুটিয়ে তোলেন সাবানে। শীতকালে ফুড কার্ভিং করার এসব সবজি অল্প দামে পাওয়া গেলেও বাকি মৌসুমে ঢাকার গুলশান ডিসিসি মার্কেট থেকে চড়া দামে কিনতে হয়। তার এ ফুড কার্ভিংয়ের বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে। সর্বনিম্ন ৮ হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন তিনি।
ফারদিনের এ ফুড কার্ভিংয়ের কাজকে একসময় ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন বাবা আব্দুর রব খান। এখন ছেলের কাজ নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ফারদিন এসব কাটাকুটির কাজ করে। আমি যখন বাজার থেকে সবজি কিনে আনতাম, সেই সবজিতে ও বিভিন্ন নকশা তৈরি করতো। আমরা বাধা দিলেও শুনতো না। একপর্যায়ে ও বড় করে এ কাজ করা শুরু করে। আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানেও করতো। এখন ও বিভিন্ন জেলায় গিয়ে একাজ করে। যেহেতু ও এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে, তাই আমরাও চাই এ শিল্প নিয়ে ও উন্নতি করুক।’
মা আফরোজা খানম বলেন, ‘আমি যখন রান্নাঘরে সবজি কাটতে বসতাম, ফারদিন আমার পাশে বসে কাটতো। ফল খেতে দিলে তাতেও ডিজাইন করতো। প্রথম প্রথম আমি রাগ করতাম, বলতাম এসব মেয়েদের কাজ তুমি কেন করো? কিন্তু ও আমাদের কথা শুনতো না। পরে আমরা মেনে নেই। এখন জানতে পারি এটিও একটি শিল্প। ও এখন এ শিল্প নিয়ে অনেক দূরে পৌঁছে গেছে। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে গর্ব করি।’
ফুড কার্ভিং আর্টিস্ট হওয়ার পেছনের গল্প জানতে চাইলে ফারদিন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু আমার পরিবার এসব পছন্দ করতো না বলে সব রং পেন্সিল ফেলে দেওয়া হয়। তারপরও বাসায় যেসব সবজি কিনে আনা হতো সেসব লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে তার ওপরে নকশা করতাম।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজে ফুড কার্ভিংকে বলা হয় ‘মেয়েদের কাজ’। তাই অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে সব বাধা-বিপত্তি পার করে এখন আমি বাংলাদেশের একজন সফল ‘ফুড কার্ভিং আর্টিস্ট’। আমার এমনও মাস যায়, যে মাসে আমি ৪-৫ লাখ টাকা আয় করি। আমার বাবা এখন আমাকে নিয়ে প্রাউড ফিল করেন।