ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মাটির তৈরি ছিকর বিস্কুট আধুনিক যুগেও ক্ষুধা নিবারণ!

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

 প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৩, ০৬:৪৫ বিকাল  

দেশ যখন ডিজিটাল যুগে স্মার্ট দেশে পরিণত হবার অভিপ্রায়, এ আধুনিক যুগেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মাটির বিস্কুট খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটাচ্ছেন। অবাক করার মতো এমন ঘটনার বাস্তব চিত্র দেখা গেছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার জুগির বিল লাগাটা নদী পারের শব্দকর সম্পাদায় জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এছাড়াও জেলার শ্রীমঙ্গল ও রাজনগরে মাটির বিস্কুটের প্রচলন রয়েছে।

এক সময় আমাদের দেশে সেই বিস্কুট তৈরী হয়ে থাকলেও আগের মতো এর কদর নেই। তবে আফ্রিকার বিভিন্ন দরিদ্র দেশের মানুষেরা আজও জীবন বাঁচাতে মাটির বিস্কুটের উপরই নির্ভরশীল। এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এই বিস্কুটের নাম ছিকর। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের দিকে ছিকর সিলেটের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে নিম্ন বিত্ত সমাজে প্রচলিত এক বিশেষ খাবার ছিল। অনেকের মতে, শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্যই নয় এক ধরনের অভ্যাসের বশেই লোকজন ছিকর খেত। কমলগঞ্জের লাগাটা গ্রামের ছিকর শিল্পীরা জানান, পাশের লাগাটা নদীর তীর থেকে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে আমরা ছিকর তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু করি। প্রথমে মাটি ভিজিয়ে রেখে মিহি করে মন্ড তৈরী করা হয়। মন্ড থেকে ছিকর তৈরি হয়।

লাগাটা গ্রামের রবেন্দ্র শব্দকর জানান, আমরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য। পূর্ব পুরুষদের রেওয়াজ অনুযায়ী ছিকর তৈরীর কাজ করে আসছি। আমাদের অভাবের সংসার। পুড়ামাটির বিস্কুট ছিকর খেয়ে অনেক সময় ক্ষুধাও নিবারণ করি।
এলাকার মোহন শব্দকর জানান, ছিকরের কদর আর আগের মতো নেই। আমরা হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। নদীর তীর থেকে এটেল মাটি সংগ্রহ করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নরম করি। তারপর কয়েক ধাপে মাটি মাখিয়ে আরো মসৃণ করা হয়। এ সময় ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরী হয় মন্ড। তারপর কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে বড় টুকরা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে গ্রাহকের চাহিদা মত কাটা হয় বিভিন্ন আকার আকৃতির ছোট বড় মাটির বিস্কুট। কাটা কাঁচা বিস্কুট এক ধরণের বিশেষ চুলায় পোড়ানো হয়। তারপর একটি মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙ্গে সেখানে লোহার সিক দিয়ে তৈরি চালুনি বসানো হয়। ওই চালুনিতে মাটির বিস্কুট বসিয়ে ছিকরের গায়ে ধানের তুষের আগুনের মৃদু তাপ দিয়ে পোড়ানো হয়। সতর্কতার সাথে ছিকরের গায়ে ধোয়া লাগানো হয়। ২ ঘন্টা পর ছিকরের গায়ে কালচে রং ধারণ করে সুঘ্রাণ তৈরী হয়।

স্বপ্না শব্দকর জানান, ছিকরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। এখন আগের মতো না থাকলেও সখের বশে অনেকে নিয়মিত খেয়ে থাকেন। এলাকা ভেদে ছিকরের স্বাদও ভিন্ন। ছিকরের মন্ড তৈরীর সময় গোলাপজল ও আদার রস দেয়া হয়। এতে মাটির সঙ্গে পোড়ানোর সময় অদ্ভুত সুন্দর এক স্বাদ পাওয়া যায়। রক্ত শূন্যতা ও খনিজের ঘাটতি পুরণে গর্ভবতী নারীদের কাছে ছিকরের জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে এই ধারণায় স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে কোন প্রমাণ নেই।

আরও পড়ুনঃ নড়াইলে শেখ রাসেলে জন্মদিন পালিত

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে ডা. মোহাম্মদ আফজালুর রহমান জানান, খাদ্য হিসেবে মাটির বিস্কুট স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে সর্মথন করে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের পাহাড়ি এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু জনগোষ্ঠীর নারীরা এইসব ছিকর তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। আবার স্থানীয় মৃৎ শিল্পীরা ছিকর তৈরি করে বাজারজাত করতেন। বর্তমানে ছিকরের কদর কমে যাওয়ায় ছিকর শিল্পীরা পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে এখনো দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছিকর তৈরি ও খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এক সময় মাটির এই বিস্কুট খেয়ে পেট ভরলেও মানুষ আধুনিক যুগে এসে এর ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন। বিলুপ্ত প্রায় এই শিল্প মনে করিয়ে দেয় অতীতের অন্ধকারের সময় গুলোকে