নতুন পদ্ধতিতে এসআই নিয়োগ: প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্নদের অগ্রাধিকার
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৩, ০৬:৫৫ বিকাল
ছবি সংগৃহীত
থানায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন এসআই বা সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। শুধুমাত্র মামলা তদন্তই নয় থানায় ডিউটি অফিসার, ছিনতাই প্রতিরোধে সড়কে টহল, অপরাধী গ্রেফতারের অভিযান ছাড়াও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের কাজ করতে হয় দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার এসব কর্মকর্তাদের। তাদের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেমন অপরাধী তালিকায় পড়ে যেতে পারে ঠিক তেমনি একজন অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে কাজ করেন সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্য পরায়ণতা সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের মাধ্যমে মামলা তদন্তসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হয় তাদের। সেই ধারাবাহিকতায় স্মার্ট পুলিশ বিনির্মাণে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন, দক্ষ, শিক্ষিত এবং মানবিক আচরণের সদস্যরা নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে নিজেদের যোগ্যতায় চাকরিতে যোগদান করছেন। পুলিশের নিয়োগে আগে আর্থিক লেনদেনের বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় উঠে আসলেও বর্তমানে তার কোনও সুযোগ নেই বলে দাবি পুলিশ দফতরের।
নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যেমন রয়েছেন কৃষক পরিবারের সদস্য, বাবা কিংবা বোন অন্যের বাড়িতে কাজ করে পড়ালেখার অর্থ যুগিয়েছেন এমন পরিবারের সদস্য, ঠিক তেমনি দেশের খ্যাতনামা প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বর্তমান সময়ে ৪০তম ক্যাডেট এসআই রিক্রুটিংয়ে প্রভাব মুক্ত হয়ে দক্ষ, শিক্ষিত, প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পন্ন, সেই সঙ্গে শারীরিক গঠন এবং জনগণকে সেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে আসা প্রাথীদের বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বের করে ৯২১ জনকে চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত রেজাল্টের ভিত্তিতে এসব তথ্য জানা গেছে। সমাজের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এই এসআই পদে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। নিজেদের যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতেই এসআই পদে সুপারিশ পেয়েছেন উত্তীর্ণরা, বলছে পুলিশ সদর দফতর। আর এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে কোনও ধরনের আর্থিক লেনদেন ছাড়াই সুপারিশ পাওয়ায় খুশি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এসআইরা। ১৭ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত হবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
আরও পড়ুনঃ নড়াইলে দুই বছরের সাজা এড়াতে ৮ বছর আত্মগোপনে,অবশেষে গ্রেফতার
সূত্র বলছে, প্রাথমিকভাবে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের তালিকায় থাকা ৯২১ জনের মধ্যে ৬৭ জন নারী এবং ৮৫৪ জন পুরুষ। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পাস করে আসা শিক্ষার্থী। এখন এসআই পদে প্রশিক্ষণ নেওয়ার অপেক্ষায়। বাকি রয়েছে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন। এই দুই ধাপে উত্তীর্ণ হলেই এক বছরের জন্য শারীরিক প্রশিক্ষণে রাজশাহীর সারদা অ্যাকাডেমিতে কঠোর পরিশ্রমে যেতে হবে। সেখান থেকে মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে দেশের বিভিন্ন থানাসহ নানান জায়গায় তাদের পদায়ন হবে।
২০২১ সালে পুলিশ রেজুলেশন ৭৪১ সংশোধন সাপেক্ষে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ উপযোগী পুলিশ তৈরির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে আবেদন করা ৬২ হাজার ৩৪৩ প্রার্থীর রেঞ্জ ভিত্তিক শারীরিক সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষা করা হয়। এতে পিইটি সাতটি ধাপ ইভেন্ট দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্প, পুশ আপ, সিট আপ, ড্রাগিং, রোপ ক্লাইমিং এ কৃতকার্য ১৮ হাজার ৮০৪ জন প্রার্থী ২৫০ নম্বরের লিখিত ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় অংশ নেন। সংশোধিত নিয়োগ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী লিখিত ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় আলাদা আলাদা বিষয়ে পঞ্চাশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৮৩৯ জন প্রার্থী কম্পিউটার দক্ষতায় অংশ নেন। কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৩১ জন প্রার্থী ৫০ নম্বরের বুদ্ধিমত্তা ও মৌলিক পরীক্ষায় অংশ নেন। শূন্য পদের আনুমানিক সংখ্যা ১৪০০ হলেও বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির সারদায় আবাসিক ও প্রশিক্ষণ সক্ষমতা অনুযায়ী ৯২১ জনকে প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করা হয়েছে।
নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সুপারিশের তালিকায় থাকা চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করা রুমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবা নেই। পাঁচ ভাই এবং তিন বোনের সংসার আমাদের। আমরা দুই বোন এখনও অবিবাহিত। অন্যদের বিয়ে হয়ে গেছে। মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়তায় বড় হয়েছি। যদিও এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে টিউশনি করে আমি আমার পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খরচ চালিয়েছি। মাস্টার্স শেষ করেও টিউশনি করেছি, অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আত্মবিশ্বাস ছিল এসআই পদে আমার চাকরি হবে। সে আত্মবিশ্বাস নিয়েই চাকরির জন্য আবেদন করি। শৃঙ্খলাবোধ, সম্মান, ইউনিফর্ম এটি আমাকে ভেতর থেকে অনেক অনুপ্রেরণা যোগাতো। আমার মা অনেক আগের মানুষ, এক কথায় নিরক্ষর। তারপরও পড়াশোনার জন্য আমার মা এবং আত্মীয়-স্বজনরাও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’
চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশে নিজের সিরিয়াল নম্বর দেখার অনুভূতি জানাতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে অনার্স পাশ করা মিলন পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবা একজন মৃৎশিল্পী। বাবা এবং মা দুজন মিলে মাটির জিনিস তৈরির পর গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন। সেই পরিবার থেকে অভাব অনটনের সংসারে এসআই পদে সুপারিশের তালিকায় নাম থাকায় বাবা-মা অনেক খুশি। আগামী শুক্রবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে পুলিশ ভেরিফিকেশন ঠিকঠাক থাকলে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগ পাবো। পুলিশের ড্রেস পরে মহৎ কাজে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারবো, এটাই আমার কাছে বড় বিষয়।’
পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র বলছে, ৯২১ জনের পরীক্ষার ফলাফলের পাশাপাশি মৌখিক পরীক্ষায় দেখা হয়েছে প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং জনগণের সেবা দেওয়ার মন-মানসিকতার বিষয়গুলো। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নর্থ সাউথ, আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসআই পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ ১৮৮ জন এসআই পদে সুপারিশ পেয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৪, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫৫, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৩, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ জন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৭২ জন নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছে। এছাড়া নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ৫ জন, আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ জন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে ২ জন এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ৪ জন সুপারিশ পেয়েছেন। কনস্টেবল পদে কর্মরত থেকে এসআই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন ৫৫ জন। প্রকাশিত নিয়োগের সুপারিশের তালিকায় প্রথম যার নম্বর রয়েছে তিনি মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল।
এছাড়া, এসআই পদে ঢাকা রেঞ্জ থেকে ৩০৭ জন, চট্টগ্রাম রেঞ্জ থেকে ১৪৯, রাজশাহী রেঞ্জ থেকে ৬৯, খুলনা রেঞ্জ থেকে ১৩৮, বরিশাল রেঞ্জ থেকে ৪২, সিলেট রেঞ্জ থেকে ৩১, ময়মনসিংহ রেঞ্জ থেকে ৯৪ এবং রংপুর রেঞ্জ থেকে ৯১ জন নিয়োগ পেয়েছেন। ঢাকা জেলা থেকে ৩৮ জন, গোপালগঞ্জ জেলা থেকে ৫৬, নরসিংদী থেকে ৩০, সুনামগঞ্জ থেকে ১৫, চাঁদপুর থেকে ১৮ এবং চট্টগ্রাম থেকে ৩৮ জন। নিয়োগের সুপারিশের তালিকায় থাকা মুসলিম ক্যান্ডিডেট ৭২০ জন, হিন্দু ১৯২, খ্রিস্টান ৪ ও বৌদ্ধ ধর্মের ৫ জন রয়েছেন।
এসআই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেধা, যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সংশোধিত নিয়োগ পদ্ধতিতে এসআই পদে মনোনীত প্রার্থীদের প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষার ৮টি ধাপ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্নকারী যোগ্য প্রার্থীদের সুপারিশ করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জব মার্কেট থেকে সর্বোত্তম প্রার্থীদের বাছাই করে নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে।’
নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যেসব ধাপ ছিল
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদন প্রক্রিয়া শুরু থেকে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয় নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া ৯২১ জনকে। এরমধ্যে প্রথম ধাপে প্রার্থীকে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, দ্বিতীয় ধাপে প্রিলিমিনারি স্ক্রিনিং, তৃতীয় ধাপে শারীরিক মাপ ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই, চতুর্থ ধাপে শারীরিক সক্ষমতা যাচাই বা ফিজিক্যাল টেস্ট যা (নতুনভাবে সাতটি প্রক্রিয়া অনুসরন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে), পঞ্চম ধাপে ওয়েব বেস্ট আবেদন ফরম পূরণ করে দাখিল, ষষ্ঠ ধাপে আড়াইশো নম্বরের লিখিত পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সপ্তম ধাপে কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়।
এছাড়া, কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষায় পাশ করার পর অষ্টম ধাপে ৫০ নম্বরের বুদ্ধিমত্তা ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। নবম ধাপে মেডিক্যাল টেস্ট বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা। দশম ধাপে পুলিশ ভেরিফিকেশন। ভেরিফিকেশনে কোনও ধরনের সমস্যা না পেলে গুরুতর কোনও অভিযোগ না থাকলে ক্যাডেট এসআই নিরস্ত্র পদে মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হবেন। পরবর্তীতে এক বছর রাজশাহীর সারদায় মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করবেন নিয়োগপ্রাপ্ত এসআইরা।